আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকার দুই মাস পার করে ফেলেছে। এই সময়ে স্বাভাবিকভাবেই ঘটেছে অনেক ঘটনা। কোনো রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন অনেক কিছু আত্মস্থ হতে সবারই কম-বেশি সময় লাগে। নানা হইচই ও হতাশা হয়তো তারই প্রতিফলন। একই সঙ্গে চলছে কেমন রাষ্ট্র বা বিশ্ববিদ্যালয় চাই, তার আলাপ-আলোচনা। যদিও এখন পর্যন্ত আলাপ নেই, কেমন আমলা বা নিরাপত্তা বাহিনী চাই। পাশাপাশি পরিবর্তন ও সংস্কার নিয়ে সামাজিক মাধ্যমেও বিতর্ক, ব্লক বা আনফ্রেন্ড করা চলছে।
আরও কিছু ইস্যু যেমন– রিসেট বাটন টেপা, পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটি বাতিল, ডিসি নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ, নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের মিছিল, পূজামণ্ডপে ইসলামী গান পরিবেশন, জামায়াত নেতার মন্ত্রপাঠ, মণ্ডপে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ কিছুদিন ধরে সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যম দখল করে ছিল। এই ডামাডোলেই বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে ‘মাস্টারমাইন্ড’।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ নিয়ে আলোচনা আগেই ছিল। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে আমেরিকা যাওয়ার পর সেটা নতুন গতি পেয়েছিল। অধ্যাপক ইউনূস সেখানে এক অনুষ্ঠানে নিজের বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে। এর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার মধ্যেই বিএনপি দাবি করছে, এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন তারেক রহমান। অপরদিকে জামায়াত এবং অন্যান্য ইসলামী দল বলছে, তারা না থাকলে এ আন্দোলন সাফল্য পেত না।
প্রশ্ন হচ্ছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড নিয়ে আলোচনা আন্দোলনে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আংশগ্রহণের ধারণা ও তেজকেই কি খারিজ করে না? প্রধান উপদেষ্টার ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইন্ড প্ল্যান’ কথাও অনেককে বিস্মিত করেছে। নিজেকে প্রশ্ন করেছেন, তাহলে আমি কি এই পরিকল্পনার অংশ ছিলাম?
নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনায় পক্ষ-বিপক্ষ থাকলেও এ ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ কম– দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। অনেকেই বলছেন, আস্তে আস্তে ঠিক হবে; সরকারকে সময় দিতে হবে। কিন্তু দুই মাস কি কম সময়?
কখনও কখনও মনে হচ্ছে, খরগোশ ও কচ্ছপের গল্পই বর্তমান সরকারের মূলনীতি কিনা? কখনও কখনও মনে হচ্ছে, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী এ সরকার নাগরিক সমাজের পরামর্শও আমলে নিচ্ছে না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন কথা শুনে মনে হচ্ছে, সরকারের মধ্যে কি সমন্বয়ের অভাব রয়েছে? নাকি শুধু নীতিমালা তৈরি করার প্রস্তাবের মধ্যেই সরকার সীমায়িত থাকতে চাইছে?
প্রথমদিকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরোধিতা করে অনেকের চুক্তি বাতিল করলেও এখন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগেই সরকারকে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী মনে হচ্ছে। আবার সে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগেও প্রাধান্য পাচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা, যারা বিএনপি-জামায়াত সমর্থক হিসেবে পরিচিত।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যের নিয়োগ নিয়েও বলা যায় একই কথা। সেখানেও কোনো নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না। মুখে মুখে যদিও একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনায় আনার কথা বলা হচ্ছে; নিয়োগের পর দেখা যাচ্ছে প্রাধান্য পেয়েছে দলীয় সমর্থন। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ যদিও সংবাদমাধ্যমকে ‘৫০০ শিক্ষক ভিসি হতে চান’ বলে দৃশ্যত উষ্মা প্রকাশ করেছেন, তিনিও ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়াটি খোলাসা করেননি। তাঁর বক্তব্য বরং বিভ্রান্তি বাড়িয়েছে; যেমন বিভ্রান্তি বাড়িয়েছে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন-সংক্রান্ত কমিটি বাতিল করতে গিয়ে ‘ভুল করে প্রজ্ঞাপিত হয়েছে’ বক্তব্যটি।
দুটি ক্ষেত্রে সরকারের অতি উৎসাহের কথা বলতেই হবে। একটি হলো হরে-দরে মামলা এবং বেশির ভাগই হত্যা মামলা। যারা ‘দাগি’ দুর্নীতিবাজ এবং যারা আওয়ামী লীগকে আদর্শিক সমর্থন দিয়েছেন, তারা সবাই একই ধরনের মামলার আসামি। যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে সোচ্চার লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরকে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটাও অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এমনকি অনেক মামলারই বাদী জানে না মামলায় আসামি কাকে করা হয়েছে? কেন করা হয়েছে?
অন্তর্বর্তী সরকারের আরেকটি কাজে সক্রিয়তা দৃশ্যমান। সেটা হলো, ছয়টি সংস্কার কমিটি গঠন। তবে বেশির ভাগ কমিটিতেই সংখ্যালঘু, নারী ও অন্যান্য গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নেই। স্বাধীনতার পর থেকেই সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে এদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী সোচ্চার। কিন্তু সংবিধান সংস্কার কমিটিতে তাদের প্রতিনিধি নেই। তাহলে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ সমাজ ও রাষ্ট্রের চিন্তাভাবনা কি শুধুই কথার কথা? আবার সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রথম সভা যেভাবে বিজয়া দশমীর দিনে অনুষ্ঠিত হলো, সেটাও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসবের দিন এমন সভা ডাকা কি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি সংবেদনশীলতার প্রমাণ?
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। খোদ সেনাপ্রধান একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হয়, সে জন্য সেনাবাহিনী অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, নির্বাচন বিষয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্য ‘অপিনিয়ন’ মাত্র; তিনি আসলে সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার ১৮ মাস পর নির্বাচনের কথা বলেছেন।
এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে সংলাপের বাইরে যে আলোচনা সংবাদমাধ্যমে এখন জায়গা করে নিয়েছে, তা হচ্ছে প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাসের শাসনামলে ইস্যুর যেন অভাব হচ্ছে না। একটি থাকতেই আরেকটি ইস্যু এসে জায়গা করে নিচ্ছে। ইস্যুর ডামাডোলে সরকারের আসল কাজগুলো কি চাপা পড়ে যাচ্ছে? যেমন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে বাজারে গিয়ে। দেখে মনে হচ্ছে, পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত আন্দোলনের কোনো ‘মাস্টারমাইন্ড’ থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাজার কীভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সে বিষয়ে সম্ভবত পরিকল্পনার খামতি ছিল। মনে হচ্ছে, আন্দোলনে থাকলেও সরকারে মাস্টারমাইন্ডের অভাব। এখন অন্তর্বর্তী সরকারে কি কোনো মাস্টারমাইন্ড থাকতে পারেন, যিনি নানা ইস্যু ও পাল্টা ইস্যুর ভিড় ঠেলে আসল কাজগুলো এগিয়ে নেবেন?
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zobaidanasreen@gmail.com